আপডেট: নভেম্বর ২৯, ২০২৩
বিএনপি-জামায়াতের চলমান সরকারবিধোরী ‘হরতাল’ কর্মসূচির দিনে বরিশালে শান্তি-সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। বুধবার সকালের ওই সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশ নেয়, যার অগ্রভাগে দেখা মেলে বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ’র। তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল ৫ সদর আসনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন। এবং ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে অতিগুরুত্বপূর্ণ এই আসনে আ’লীগ নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার অনুমতি দিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদ ফারুক শামীমকে, তিনি বর্তমানে বরিশাল ৫ আসনের এমপি, এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও। জানা গেছে, জাহিদ ফারুক শামীম আজ বুধবার জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা করেছেন। নৌকার প্রার্থী যখন মনোনয়ন জমাদান নিয়ে ব্যস্ততায় সময় পার করছিলেন, ঠিক তখনই বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহ হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে মহড়া দিয়ে নিজের শক্তি জাহির করলেন। নির্বাচনী প্রস্তুতির মধ্যে সাদিকের আকস্মিক এই মহড়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের হরতালের প্রতিবাদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিকের মহড়ার নেপথ্যে বেশ কিছু মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ আছে, সেক্ষেত্রে তার এভাবে মাঠে নামাকে নির্বাচনী মহড়া হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
অবশ্য কথিত আছে, বরিশাল সদর আসনের নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুকের তুলনায় সাবেক সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ স্থানীয় রাজনীতিতে এক ধাপ এগিয়ে আছেন। সাদিক মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা হওয়ায় তিনি গত কয়েক বছরের বিশাল কর্মীবাহিনী বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। যে কোনো মুহূর্তে তাঁর একটি ঘোষণা হাজার হাজার নেতাকর্মী রাস্তায় নেমে আসে।
বলা হচ্ছে, সেই নেতাকর্মীদের আবদার রক্ষার্থেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত সাদিক স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে সিদ্ধান্তগ্রহণ করেছেন। যদিও ২৬ নভেম্বর মনোনয়ন ঘোষণার আগ পর্যন্ত সাদিক বলে আসছিলেন, নেত্রী যাকে নৌকা দেবেন, তার পক্ষেই কাজ করবেন তিনি। অথচ রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেই সাদিক আব্দুল্লাহ নৌকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। এবং নির্বাচনী প্রস্তুতির মধ্যেই হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে মহড়া দিয়ে দেখালেন রাজপথে শক্তি কমে যায়নি।
এই মহড়াকে নৌকা প্রার্থী জাহিদ ফারুকের কর্মীরা বাকা চোখে দেখলেও পর্যবেক্ষক মহল বলছে, শান্তি সমাবেশ করে সাদিক আব্দুল্লাহ যেমন রাজপথে থাকার ম্যাসেজ দিলেন, তেমনি কিছু ম্যাসেজও নিলেন। বিশেষ করে মহড়ার কৌশল হচ্ছে এতদিন যে সংখ্যক কর্মী-সমর্থক তার বন্দনা করতো, মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর তা কমেছে কী না এটা দেখা। এছাড়া নির্বাচনী মাঠে নেতাকর্মীদের মনবল চাঙা করার একটা অভিনব পন্থা বলেও মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া সমাবেশে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বরিশাল সদর আসনে নৌকার প্রার্থী জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি জাহিদ ফারুককে উদ্দেশ করে ক্ষুব্ধস্বরে বলেছেন, এই জনপদ এক সময় বিএনপির ঘাটি ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে তাদের নেতা সাদিক আব্দুল্লাহ এখন বরিশালে ফসল ফলিয়েছেন, আর সেই ফসল বহিরাগতরা এসে নিয়ে যাবে তা হতে দেওয়া যাবে না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, নেতাকর্মীদের আবদারে সাদিক আব্দুল্লাহ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তার পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কাজ করবে।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা মনোনয়ন বঞ্চিতদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে সুযোগ করে দিয়েছেন, সেক্ষেত্রে সাদিক আব্দুল্লাহ প্রার্থী হতেই পারেন। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন ‘খেলা হবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর। এই শান্তি সমাবেশ এবং সাদিক প্রার্থী হওয়া নিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিক্ষুব্ধ বক্তব্য পোক্ত আভাস দিয়েছে বরিশাল ভোটের মাঠে নৌকার বিপরিতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ।
অবশ্য আজ নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনিই আওয়ামী লীগের অরিজিনাল প্রার্থী এবং তাকে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা নৌকা দিয়েছেন। যারা শেখ হাসিনার ওপর আস্থা-বিশ্বাস রাখেন এবং যারা আওয়ামী লীগপন্থী তারাই নৌকার পক্ষে কাজ করবেন।
এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সাদিক আব্দুল্লাহ মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের নির্বাচনে তার পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা ইতিমধ্যে নগরীর ওয়ার্ড এবং সদর উপজেলার ইউনিয়নসমূহে সাদিকের প্রার্থিতার প্রচারও চালাতে শুরু করেছেন।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে থেকে সাদিক বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে বেকে বসলে চাপে পড়তে হবে নৌকার প্রার্থীকে। সেক্ষেত্রে জাহিদ ফারুক এবং সাদিক আব্দুল্লাহ’র কর্মী-সমর্থকেরা বরিশাল শহরকে সংঘাতময়ও করে তুলতে পারেন। উদাহরণস্বরুপ সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে, ১২ জুনের সিটি নির্বাচনকে। ওই নির্বাচনে সাদিক আব্দুল্লাহ’র পরিবর্তে নৌকার প্রার্থী হয়ে তার আপন চাচা আবুল খায়ের ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। মনোনয়ন বঞ্চিত সাদিক ওই সময় বরিশালে না আসলেও তার সমর্থিত নেতাকর্মীরা ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে নৌকার বিরুদ্ধাচারণের অভিযোগ ওঠে। এবং এনিয়ে সংঘাত-রক্তপাতে বরিশাল নগর উত্তপ্ত হয়। এমনকি সাদিক অনুসারী তৎকালীন মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ২ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী রইজ আহম্মেদ মান্নাকে নৌকার কর্মীদের মারধর অভিযোগে জেলে যেতেও হয়েছিল।
এবার সংসদ নৌকার বিরুদ্ধে সাদিকের অবস্থান এবং নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া পূর্বেকার সেই সংঘাতময় পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করবে কী না এনিয়েও নানান কথা শোনা যায়। বরিশালের এই পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এখন পর্যন্ত কোনো মুখ খোলেনি।
তবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, শুধু বরিশালে নয়, অধিকাংশ স্থানেই এবার মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগ নেতারা প্রার্থিতা করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে আছেন। বিষয়টি খোদ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও অবগত। এবং তিনিই মনোনয়ন বঞ্চিতদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের অপশন হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ রেখেছেন। কিন্তু এনিয়ে এখন দলে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। হয়তো এর সমাধানও তিনি দেবেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ সধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বুধবার মিডিয়ায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে সুযোগ আছে। কিন্তু কিছু কৌশল ও হিসেবও আছে। এবং এও বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী কারা হবেন তা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু ফ্রি স্টাইলে প্রার্থী হওয়া যাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্য আলোচনায় এসেছে, তাহলে কিছু আসন প্রার্থিতার জন্য উন্মুক্ত থাকছে, আর সে রকমের কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে বরিশাল ৫ আসনের ক্ষেত্রেও। হয়তো এই প্রশ্নে উত্তর শিগগিরই মিলবে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিদ্ধান্ত আসবে।’