আপডেট: মে ৭, ২০২৩
ভারত মহাসাগরের ছো্ট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। অথচ কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রটিতে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে এশিয়ার দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও চীন। মালদ্বীপ নিয়ে রীতিমতো দুই দেশের প্রতিযোগিতা চলছে। আর বৃহৎ দুই রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতায় এক প্রকার চিড়ে চ্যাপ্টা দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটি।
১৯৬৫ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হয় মালদ্বীপ। নতুন রাষ্ট্রটিকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর একটি হলো ভারত। প্রতিবেশী হিসেবে ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্ক বহু পুরনো। অপরদিকে ২০১১ সালের আগে মালদ্বীপে চীনের কোনো দূতাবাসই ছিল না। বেইজিং যখন আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য বাড়াতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআিই) কর্মসূচি হাতে নেয়, মূলত তখনই মালদ্বীপ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
মালদ্বীপে নিজের পুরনো প্রভাব বজায় রেখেছে ভারত। বিশেষ করে ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহর শাসনামলে বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ সুবিধা পাচ্ছে ভারত। কারণ ২০১৮ সালে ক্ষমতায় বসা সোলিহ প্রশাসনের নীতিই হলো- ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট (ভারত প্রথম)’। দেশটির বিভিন্ন প্রকল্পে ২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারত।
এর মধ্যে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইনের অধীনে ১০০ শয্যার একটি অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল এবং মালদ্বীপে ২২ হাজার আসনবিশিষ্ট একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি করা অন্তর্ভুক্ত। কোভিড-১৯ চলাকালে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ভারত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন উপহার দেয় মালদ্বীপকে। যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গাঢ় করে। তবে দেশটিতে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে পিছিয়ে ছিল বেইজিং। কারণ প্রথম চীনা ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মার্চের শেষে মালদ্বীপে পৌঁছেছিল।
ভারত ২০২১ সালের আগস্ট মাসে গ্রেটার মেল কানেকটিভিটি প্রজেক্ট (জিএমসিপি) শুরু করেছিল, যা মালদ্বীপের বৃহত্তম পরিকাঠামো প্রকল্প। ৬ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু এবং কজওয়ে সংযোগ নির্মাণের ব্যয় প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে হানিমাধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের গ্রাউন্ড ব্রেকিং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। একটি লাইন অফ ক্রেডিটের মাধ্যমে এই প্রকল্পে ১৩৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ করেছে ভারতীয় কোম্পানি জেএমসি প্রজেক্টস লিমিটেড।
অস্ট্রেলিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল ইন্ড্রাকশন স্কিম (এআইসিআইএস) বলছে, গত ১ মে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তার মালদ্বীপের প্রতিপক্ষ মারিয়া আহমেদ দিদির আমন্ত্রণে ৩ দিনের সরকারি সফরে মালদ্বীপে গিয়েছিলেন। ওই সময় তারা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করার জন্য দ্বিপাক্ষিক প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনা করেন। এ ছাড়া গত ২ মে ভারত একটি অনুষ্ঠানে মালদ্বীপের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অ্যাসল্ট ল্যান্ডিং ক্রাফটসহ একটি দ্রুত টহল জাহাজ হস্তান্তর করে।
২০১২ সালে মালদ্বীপে একটি রাজনৈতিক সংকটের সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যাকে ভারতপন্থী বলে মনে করা হতো। এর পর চীনের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে পরিচিত তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওয়াহেদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
এশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর চায়না অ্যান্ড আইওআর স্টাডিজ (এআইসিআইএস) বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের শাসনকালে মালদ্বীপে চীনের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই সময় চীন সরকার দেশটির প্রধান অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে প্রচুর বিনিয়োগ করে।
ভারত মহাসাগরের ছোট দ্বীপ দেশ মালদ্বীপ গত এক দশকে চীনের জন্য ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করার যে কৌশল চীনের, মালদ্বীপও এর ব্যতিক্রম নয়।
মালদ্বীপে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব ২০১৩ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ দেশটি বিনিয়োগ এবং পর্যটনের একটি প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। চীন মালদ্বীপকে অনুদান ও ঋণের আকারে আর্থিক সহায়তাও দিয়েছে। আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সময় মালদ্বীপকে চীন ঋণের ফাঁদে ফেলেছিল। তার শাসনামলেই চীনের প্রথম কোনো শাসক হিসেবে শি জিনপিং ২০১৪ সালে মালদ্বীপে রাষ্ট্রীয় সফর করেছিলেন।
মালদ্বীপ ওই সময়ের মধ্যে অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছিল। দেশটির কাছে চীনা ঋণ ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে হুলহুমেল দ্বীপে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিএসসিইসি) নির্মিত ৭ হাজার হাউজিং ইউনিটের মতো বেশ কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় রাস্তা এবং সেতুসহ আরও কয়েকটি ভ্যানিটি অবকাঠামো প্রকল্পও ছিল। স্থানীয়দের কর্মসংস্থানকে উপেক্ষা করে বেশিরভাগ অবকাঠামো প্রকল্পে চীনা প্রকৌশলী এবং বিদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি ছিল মালদ্বীপের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি নতুন রানওয়ে নির্মাণ, যেখানে অর্থায়ন করেছিল চীনা সরকার এবং কাজটি করেছে একটি চীনা কোম্পানি। বিতর্কিত ওই প্রকল্পটি নিয়ে মালদ্বীপে ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে।
মালদ্বীপ ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর চীনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করেছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ছিল। ওই চুক্তিটি চীন এবং মালদ্বীপের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্বীপরাষ্ট্রটিতে বৃহত্তর চীনা বিনিয়োগকে সহজতর করবে বলেও আশা করা হয়েছিল। চুক্তিটি বিরোধীদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এটিকে মালদ্বীপকে চীনের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার শামিল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মালদ্বীপের অনেক সমালোচক বলেছেন, এই চুক্তির ফলে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক ক্ষতি হবে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এর আগে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিও পাল্টেছে। ক্ষমতাসীন মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি) অভ্যন্তরীণ বিভাজনের মুখোমুখি হয়েছে, যার ফলে দলটির ভোট ভাগাভাগি হতে পারে। ক্ষমতাসীন এমডিপি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের অধীনে একটি ‘ভারত-প্রথম’ নীতি অনুসরণ করছে।
নাশিদ ও সোলিহর প্রশাসনে দুর্নীতি এবং অপশাসনের অভিযোগ রয়েছে। ফলে এমডিপি প্রতিদ্বন্দ্বী দলে বিভক্ত হতে পারে বলে উদ্বেগ রয়েছে। যার সুবিধা নিতে পারে বিরোধীরা। তবে মালদ্বীপ প্রগ্রেসিভ পার্টিও (পিপিএম) চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন বর্তমানে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৩ সালের নির্বাচন মালদ্বীপের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে কৌশলগত প্রভাবের জন্য যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে চীন ও ভারত।